একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর তিনি ব্যাংকে যে অর্থ গচ্ছিত রেখে গেছেন কিংবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, সেই অর্থ পাবে কে? নমিনি না উত্তরাধিকারী? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত আইন এবং বিভিন্ন কেস ল’র আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করব।
নমিনি ও উত্তরাধিকারী: ভূমিকার পরিষ্কার ধারণা
একজন ব্যক্তি যদি মৃত্যুর পূর্বে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা সঞ্চয়পত্রের জন্য নমিনি নির্ধারণ করে যান, তবে মৃত্যুর পর সেই নমিনিই উক্ত অর্থ উত্তোলনের অধিকার পাবেন। তবে নমিনি নির্ধারিত না থাকলে, মৃত ব্যক্তির আইনি উত্তরাধিকারীগণ সাকসেশন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে সেই অর্থ দাবি করতে পারবেন।
বাংলাদেশে এখনো অনেকেই নমিনি নির্ধারণের ব্যাপারে সচেতন নয়। অথচ নমিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ আইনি ব্যক্তি, যিনি প্রাথমিকভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ গ্রহণের অধিকারী হন।
নমিনির দায়িত্ব ও আইনি বাধ্যবাধকতা
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে, নমিনির কাজ শুধুমাত্র অর্থ উত্তোলন করা, কিন্তু সেটি নিজের মালিকানা হিসেবে রাখা নয়। অর্থ উত্তোলনের পর পার্সোনাল ল’ অনুযায়ী যথাযথ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অর্থ বণ্টন করা নমিনির দায়িত্ব।
যদি নমিনি এই দায়িত্ব পালন না করে অর্থ আত্মসাৎ করে, তবে উত্তরাধিকারীগণ তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন—যেমন মানি সুট বা সাকসেশন মামলা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।
প্রচলিত আইনের আলোকে নমিনির অধিকার
নিচে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনের আওতায় নমিনির অধিকার নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিধানসমূহ তুলে ধরা হলো:
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ – ধারা ১০৩(১)
আমানতকারী মৃত্যুবরণ করলে, মনোনীত ব্যক্তি তার আমানতের অর্থ উত্তোলনের অধিকার রাখেন।
৭৩ ডিএলআর (হাইকোর্ট ডিভিশন), পৃষ্ঠা ২২৭
ফিরোজা বেগম বনাম দ্য গভঃ অফ পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ মামলায় আদালত বলেছেন
“Nominee shall be entitled to receive the money/benefits of the deceased… and every other person shall be deprived of those rights.”
অর্থাৎ, নমিনির একচেটিয়া অধিকার রয়েছে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের অর্থ উত্তোলনে।
সঞ্চয়পত্র বিধিমালা, ১৯৭৭ (সংশোধিত ২০১৫)
- রুল ১৭: নমিনি থাকলে মৃত্যুর পর তারা নির্ধারিত অংশে অর্থ পাবেন।
- রুল ১৬: নমিনি না থাকলে উত্তরাধিকারীরা সাকসেশন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে অর্থ পাবেন।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা, ২০০৪ (সংশোধিত ২০১৫)
রুল ৮(৬): নমিনি নির্ধারিত থাকলে তারাই নির্ধারিত অংশে অর্থ পাবেন। না থাকলে উত্তরাধিকারীগণ পার্সোনাল ল’ অনুযায়ী প্রাপ্য হবেন।
সরকারি ঋণ আইন, ২০২২
- ধারা ১৭ (১)(খ): জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে নমিনি নির্ধারিত থাকলে, তারাই অর্থ পাবেন।
- ধারা ১৮ (১): মৃত্যুর পর নমিনি কার্যকর থাকলে, সেই সিকিউরিটি বা সার্টিফিকেটের অর্থ নমিনি পাবেন।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণ ও পরামর্শ
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী
নমিনি নির্ধারিত থাকলে: তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বা সঞ্চয়পত্রের অর্থ উত্তোলনের একচেটিয়া অধিকারী হবেন।
তবে তিনি সেই অর্থ নিজের করে নিতে পারবেন না—পার্সোনাল ল’ অনুযায়ী উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে বণ্টন করতে বাধ্য থাকবেন।
নমিনি না থাকলে: উত্তরাধিকারীগণ সাকসেশন সার্টিফিকেট গ্রহণ করে অর্থ দাবি করতে পারবেন।
ব্যাংকের দায়িত্ব: শুধু নমিনিকে অর্থ প্রদান করেই ব্যাংক তাদের আইনি দায়িত্ব পালন করবে।
ওয়ারিশদের দায়িত্ব: নমিনির কাছ থেকে ন্যায্য অংশ বুঝে নেওয়া এবং প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মৃত ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা নমিনি নিয়ে ফেললে উত্তরাধিকারীরা কী করতে পারেন?
তারা সিভিল কোর্টে মামলা করে অর্থ ফেরত চাইতে পারেন এবং আইনি বণ্টনের দাবি করতে পারেন।
মৃত ভাইয়ের সম্পত্তি কাকে দেয়া হবে?
ভাই নিঃসন্তান হলে তার স্ত্রী, মা-বাবা, জীবিত ভাই/বোনরা উত্তরাধিকারী হতে পারেন। এটি নির্ভর করে পরিবারের গঠন ও ধর্মীয় আইনের ওপর।
নমিনি ও উত্তরাধিকারীর ভূমিকা
নমিনির অধিকার
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী, হিসাবধারী মৃত্যুবরণ করলে তার মনোনীত নমিনিকে গচ্ছিত টাকা প্রদান করা হয় । বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনায় এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।
নমিনির দায়িত্ব
নমিনি শুধুমাত্র ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের অধিকারী। তিনি ওই অর্থের মালিক নন। তার দায়িত্ব হলো, উত্তোলিত অর্থ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা ।
আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি
২০১৬ সালে হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে নমিনি অর্থের মালিক নন; বরং তিনি একজন ট্রাস্টি, যার দায়িত্ব হলো উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অর্থ বণ্টন করা ।
নমিনি না থাকলে করণীয়
যদি মৃত ব্যক্তি কোনো নমিনি নির্ধারণ না করে যান, তাহলে উত্তরাধিকারীদের সাকসেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে অর্থ উত্তোলন করতে হবে ।
মৃত ভাইয়ের সম্পত্তি বন্টন কিভাবে হবে?
মৃত ভাই যদি বিবাহিত ও সন্তানসম্ভবা হন, তবে তার সম্পত্তি পিতামাতার অনুপস্থিতিতে ভাইবোনেরা তার ওয়ারিশ হবে। তবে ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী, ভাইয়ের স্ত্রীর একটি নির্দিষ্ট অংশ থাকবে এবং অবশিষ্ট সম্পত্তি ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ হবে।
মৃত বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম কী?
ত বাবার সম্পত্তি মুসলিম আইন অনুসারে ভাগ হয় পুত্র, কন্যা, স্ত্রী এবং অন্য নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। সাধারণত পুত্র পায় দ্বিগুণ, কন্যা পায় এক গুণ। যদি কন্যা একমাত্র সন্তান হন, তাহলে নির্দিষ্ট শর্তে তিনি পুরো সম্পত্তির অধিকার পেতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, যদি ২ পুত্র ও ১ কন্যা থাকে, তবে সম্পত্তির হিসাব হবে: ২:২:১ অনুপাতে।
জমি বন্টন আইন বাংলাদেশে কীভাবে কাজ করে?
বাংলাদেশে জমি বন্টনের আইন শরীয়াহ আইন (মুসলিমদের জন্য) এবং হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী প্রয়োগ হয়। মুসলিমদের ক্ষেত্রে জমি বা যে কোনো স্থাবর সম্পত্তি শরীয়াহর নিয়ম অনুসারে বন্টন করা হয় এবং এর জন্য সাধারণত উত্তরাধিকার সনদ ও নামজারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।
উপসংহার
ব্যাংকে বা সঞ্চয়পত্রে গচ্ছিত অর্থের ক্ষেত্রে নমিনি নির্ধারণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার বিতর্ক এড়াতে সহায়ক হতে পারে। তবে নমিনি হওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি একমাত্র মালিক—তাকে অবশ্যই ধর্মীয় ও পারিবারিক উত্তরাধিকার আইনের ভিত্তিতে অর্থ বণ্টন করতে হবে।
FAQ – প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১. মৃত ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা কে পাবে?
যদি নমিনি থাকে, তাহলে নমিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন। তবে তিনি নিজের মতো করে সেই টাকা রাখতে পারবেন না—আইনি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করতে বাধ্য থাকবেন।
২. নমিনি কি মৃত ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা একাই নিতে পারবেন?
না। নমিনি কেবলমাত্র টাকা তোলার ক্ষমতা রাখেন, মালিকানা দাবির অধিকার রাখেন না। টাকা উত্তোলনের পর উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করতে হয়।
৩. যদি নমিনি না থাকে, তাহলে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা কীভাবে পাওয়া যাবে?
নমিনি না থাকলে, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ আদালত থেকে সাকসেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন।
৪. মৃত ব্যক্তির ব্যাংকের টাকা নিয়ে সমস্যা হলে কোথায় অভিযোগ করা যায়?
প্রথমে ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। প্রয়োজনে মানি স্যুট বা সিভিল কোর্টে সাকসেশন মামলা করা যায়।