মৃত্যু নিবন্ধন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার সঠিক আইনি পরিচিতি প্রদান করে। বাংলাদেশে অনলাইনে মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়া ২০২৫ সালে আরও সহজ এবং দ্রুত করা হয়েছে। এই নিবন্ধনটি মৃত্যুর পর সরকারি রেকর্ডে মৃত্যুর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে এবং সঠিকভাবে মৃত্যুর কারণ যাচাই করে।
মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন কেন প্রয়োজন, অনেকেই এটি বুঝে উঠতে পারেন না। এটি শুধুমাত্র একটি কাগজ নয়, বরং মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে সরকারের নথিভুক্ত স্বীকৃতি। নিচের কিছু কারণে এটি প্রয়োজনীয়:
মৃত্যু তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত
সম্পত্তি বণ্টনের সময় আইনি প্রমাণ
মৃত ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা
পেনশন ও সরকারি সুবিধা গ্রহণ
মৃত্যু নিবন্ধনের আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি
- মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকা আবশ্যক
মৃত্যুর সনদ তৈরি করার জন্য মৃত ব্যক্তির সঠিক জন্ম নিবন্ধন নম্বর থাকতে হবে। যদি এটি না থাকে, তাহলে আগে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে হবে। - মৃত্যুর নির্ভুল তারিখ ও স্থান
মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর তারিখ (যেমন: দিন, মাস, বছর) এবং মৃত্যুর স্থান (বাড়ি, হাসপাতাল ইত্যাদি) স্পষ্টভাবে জানতে হবে। ভুল তথ্য দিলে আবেদন বাতিল হতে পারে। - মৃত্যুর কারণ
ডেথ সার্টিফিকেট বা চিকিৎসকের দেওয়া রিপোর্ট থেকে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। এটি স্বাস্থ্য ও পরিসংখ্যান বিভাগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। - আবেদনকারীর সঠিক তথ্য
আপনি যিনি আবেদন করবেন, তার জন্ম নিবন্ধন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক (যেমন: পিতা, মাতা, সন্তান, স্বামী/স্ত্রী) নির্ভুলভাবে দিতে হবে। - সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টস প্রস্তুত রাখা
অনলাইনে আবেদন করতে হলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যেমন NID, জন্ম সনদ, ডেথ সার্টিফিকেট (যদি থাকে) স্ক্যান করে প্রস্তুত রাখতে হবে। - সঠিক মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা
অনলাইনে যোগাযোগের জন্য সঠিক মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা দেওয়া জরুরি, যাতে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীর সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
মৃত্যু নিবন্ধন এখন আরও সহজ – ঘরে বসেই আবেদন করুন
বর্তমানে অনলাইনে মৃত্যু নিবন্ধনের প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে। আপনি নিজের হাতে থাকা একটি মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করে খুব সহজেই আবেদন করতে পারেন। আর এতে করে ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার অফিসে গিয়ে লাইন ধরতে হয় না, বরং আপনি নিজে নিজেই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন।
নিজে আবেদন করলে সুবিধা কী?
- ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার বা অফিসে না গিয়ে নিজে আবেদন করলে সময় এবং খরচ উভয়ই বাঁচে।
- নিজে করা আবেদনে ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, কারণ আপনি নিজে তথ্য যাচাই করে পূরণ করছেন।
- আবেদন জমা দেওয়ার পর সেটি সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে চলে যাবে – ফলে অফিসে যেতে না হলেও তারা অনলাইনে সেটা দেখতে পারবে।
- আপনি সহজেই আবেদন যাচাই ও সনদ ডাউনলোড করতে পারবেন।
তবে মনে রাখবেন, অনলাইন আবেদন করলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় অফিসে যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে। তাই আবেদনের তথ্য নির্ভুলভাবে দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়
অনলাইনে বা অফলাইনে মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করতে গেলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বা ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়। নিচে তালিকাভুক্ত করা হলো, কী কী ডকুমেন্ট আপনার লাগতে পারে এবং কীভাবে তা প্রস্তুত করবেন:
১. মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন সনদ
মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ অন্যতম প্রধান ডকুমেন্ট। এটি অবশ্যই ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় ডিজিটাল ফরম্যাটে হতে হবে। আবেদন করার আগে নিশ্চিত করুন যে জন্ম সনদে থাকা তথ্য (নাম, জন্ম তারিখ) মৃত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট অথবা শিক্ষা সনদের সাথে সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।
মিল না থাকলে কী করবেন?
যদি জন্ম সনদে তথ্যের মিল না থাকে, তবে আগে সংশোধনের জন্য আবেদন করে সঠিক করে নিন। ভুল তথ্য নিয়ে আবেদন করলে তা বাতিল হতে পারে।
২. মৃত ব্যক্তির পরিচয়পত্র
যদি মৃত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), পাসপোর্ট বা শিক্ষা সনদ থাকে, তাহলে তার কপি আপলোড করতে হবে। এতে করে মৃত্যুর আবেদন যাচাই সহজ হয়।
৩. মৃত্যুর কারণ ও তারিখ
আবেদনে মৃত্যুর কারণ এবং মৃত্যুর তারিখ নির্ভুলভাবে দিতে হবে। এটি হাসপাতাল থেকে পাওয়া মৃত্যু সার্টিফিকেট বা চিকিৎসকের দেওয়া সনদের ভিত্তিতে নির্ধারণ করুন।
৪. আবেদনকারীর তথ্য
যিনি আবেদন করছেন তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম নিবন্ধন নম্বর এবং মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: ছেলে/মেয়ে/স্বামী/স্ত্রী ইত্যাদি।
মৃত্যু নিবন্ধন অনলাইন আবেদন করার ধাপসমূহ
বর্তমানে অনলাইনে ঘরে বসেই মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করা যায় খুব সহজেই। এজন্য আপনাকে শুধু কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে। নিচে ধাপে ধাপে বিস্তারিত প্রক্রিয়াটি তুলে ধরা হলো:
ধাপ ১: অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন

প্রথমে আপনার মোবাইল ফোন অথবা ডেস্কটপের যেকোনো একটি ইন্টারনেট ব্রাউজার (যেমন Google Chrome, Firefox) খুলুন। এরপর ব্রাউজারে টাইপ করুন:
www.bdris.gov.bd
এই ওয়েবসাইটটি হলো বাংলাদেশ সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ব্যবস্থার অফিসিয়াল পোর্টাল।
এখান থেকেই আপনি মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন।
ধাপ ২: জন্ম নিবন্ধনের তথ্য দিয়ে অনুসন্ধান করুন

ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর,
- মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন নম্বর লিখুন
- জন্ম তারিখ দিন
- নিচে প্রদত্ত ক্যাপচা (Captcha Code) সঠিকভাবে বসিয়ে “অনুসন্ধান করুন” বাটনে ক্লিক করুন
ধাপ ৩: তথ্য যাচাই ও আবেদন শুরু করুন

অনুসন্ধান করার পর, আপনি মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধনের তথ্য দেখতে পাবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে, নিচে
এখানে আপনি নিশ্চিত করুন:
- নাম, জন্ম তারিখ, পিতার নাম, মাতার নামসহ সব তথ্য সঠিক আছে কিনা।
- যদি সব তথ্য ঠিক থাকে, তাহলে “নির্বাচন” অপশনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৫: কনফার্মেশন পপ-আপ

নির্বাচনে ক্লিক করার পর একটি পপ-আপ উইন্ডো আসবে, যেখানে লেখা থাকবে:
“আপনি কি নিশ্চিতভাবে মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে চান?”
সেখানে “হ্যাঁ” অথবা “কনফার্ম” অপশন সিলেক্ট করে পরবর্তী ধাপে যান।
ধাপ ৬: নিবন্ধনকারীর ঠিকানা ও আবেদন ফর্ম পূরণ

মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করতে হলে নিবন্ধনকারীর ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। এই ধাপে একটি ফর্ম আসবে, যেখানে নিচের তথ্যগুলো দিতে হবে:
দেশের নাম নির্বাচন করুন
বিভাগ নির্বাচন করুন (যেমন: খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি)
জেলা নির্বাচন করুন
উপজেলা নির্বাচন করুন
এরপর আপনাকে সিটি কর্পোরেশন / পৌরসভা / ইউনিয়নের মধ্যে সঠিকটি নির্বাচন করতে হবে
সবশেষে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করুন, যেখানে আপনি আবেদন জমা দিতে চান
গুরুত্বপূর্ণ: ইউনিয়ন সিলেক্ট করার পর অফিসের নাম অটোমেটিকভাবে সিলেক্ট হয়ে যাবে। আপনাকে আলাদা করে অফিস নির্বাচন করতে হবে না। এরপর নিচে থাকা “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৬: নিবন্ধনকারীর ঠিকানা পূরণ করুন
এই ধাপে আপনাকে মৃত্যু নিবন্ধনকারীর ঠিকানা সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। ঠিকানা পূরণের সময় নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন:
- দেশের নাম নির্বাচন করুন
- বিভাগ নির্বাচন করুন
- জেলা ও উপজেলা সঠিকভাবে দিন
- এরপর আপনার এলাকাভেদে সিটি কর্পোরেশন / পৌরসভা / ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করুন
- সর্বশেষে ইউনিয়ন পরিষদ সিলেক্ট করুন
গুরুত্বপূর্ণ: ইউনিয়ন সিলেক্ট করার পর অফিসের নাম অটোমেটিকভাবে সিলেক্ট হয়ে যাবে। আপনাকে আলাদা করে অফিস নির্বাচন করতে হবে না। এরপর নিচে থাকা “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৮: আবেদনকারীর তথ্য প্রদান করুন

ধাপ ৯: প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংযোজন

মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন সম্পন্ন করতে হলে আপনাকে কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করতে হতে পারে। এই ধাপে যা করতে হবে:
- ডকুমেন্টগুলো JPG, JPEG, PNG ফরম্যাটে হতে হবে
- প্রতিটি ডকুমেন্টের সর্বোচ্চ সাইজ: ২ মেগাবাইট
- যদি নতুন করে কোনো ডকুমেন্ট যুক্ত করতে চান, তাহলে “সংযোজন গঠন” (Attach Document) বোতামে ক্লিক করুন
- তারপর “ডকুমেন্ট নির্বাচন করুন” অপশনে ক্লিক করে আপনার প্রয়োজনীয় ফাইলটি আপলোড করুন
টিপস: ডকুমেন্ট হিসেবে আপনি যেমন মৃত্যু সনদ, হাসপাতালের সনদ, অথবা মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত কাগজপত্র যুক্ত করতে পারেন।
ধাপ ১০: মোবাইল নম্বর প্রদান ও ওটিপি যাচাইকরণ

মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই একটি মোবাইল নম্বর প্রদান করতে হবে। এই মোবাইল নম্বরে একটি ওটিপি (OTP – One Time Password) পাঠানো হবে।
- নির্ভরযোগ্য একটি মোবাইল নম্বর দিন
- “ওটিপি পাঠান” বোতামে ক্লিক করুন
- মোবাইলে প্রাপ্ত ৬ সংখ্যার ওটিপি কোডটি নির্ধারিত ঘরে সঠিকভাবে লিখুন
- এরপর “নিশ্চিত করুন/সাবমিট করুন” বাটনে ক্লিক করুন
গুরুত্বপূর্ণ: এই ওটিপির মাধ্যমে আপনার আবেদনটি ভেরিফাই হয় এবং মৃত্যুনিবন্ধনের অনলাইন আবেদন সম্পূর্ণ হয়।
ধাপ ১১: আবেদন আইডি প্রাপ্তি ও আবেদন সম্পন্ন
ওটিপি সঠিকভাবে সাবমিট করার পরপরই আপনি একটি আবেদন আইডি (Application ID) পাবেন। এই আবেদন আইডিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে:
- আপনি আপনার মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদনের বর্তমান অবস্থা অনলাইনে ট্র্যাক করতে পারবেন।
- আবেদনটি ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় রেজিস্ট্রার অফিসে দ্রুত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
- আপনি আপনার আবেদনের কপি (Application Copy) অনলাইনে ডাউনলোড করতে পারবেন।
পরামর্শ: আবেদন আইডি টি সংরক্ষণ করে রাখুন। প্রয়োজনে এটি দিয়ে ভবিষ্যতে যেকোনো আপডেট বা সংশোধন করা সম্ভব হবে।
FAQ – সাধারণ জিজ্ঞাসা:
১. অনলাইনে মৃত্যু নিবন্ধন যাচাই কীভাবে করব?
উত্তর: https://everify.bdris.gov.bd লিঙ্কে গিয়ে ১৭ ডিজিটের নিবন্ধন নম্বর দিয়ে যাচাই করতে পারবেন।
২. সরকারি কোন অ্যাপস দিয়ে মৃত্যু নিবন্ধন যাচাই করা যায়?
উত্তর: এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো অ্যাপস নেই, তাই ওয়েবসাইটই একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আমার পিতার মৃত্যু হলে আমি প্রথমবারের মতো মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন অনলাইন করি। শুরুতে কিছু তথ্য না জানার কারণে দ্বিধায় পড়েছিলাম, কিন্তু BDRIS পোর্টালের সাহায্যে ধাপে ধাপে আবেদন করে সফলভাবে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করতে পেরেছি। এখন আমি চাই, যারা নতুন করে আবেদন করতে চান, তারা যেন সহজে ও দ্রুত এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারেন।