বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, তার মৃত্যুর পরে সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন হয় উত্তরাধিকার সনদ
এই সনদ সরকারি, আইনি এবং ব্যক্তিগত কাজে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বর্তমানে এটি অনলাইন ও অফলাইন উভয় পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা যায়।
এই আর্টিকেলে আমরা জানবো উত্তরাধিকার সনদ কী, এটি কেন প্রয়োজন, কীভাবে আবেদন করতে হয়, কী কাগজপত্র লাগে, এবং আরও অনেক কিছু।
উত্তরাধিকার সনদ হলো একটি সরকারি দলিল, যার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারীরা নির্ধারিত হয়। এটি জমি হস্তান্তর, ব্যাংক হিসাব পরিচালনা, বীমা দাবি, এবং অন্যান্য আইনি কাজে ব্যবহৃত হয়।
অনলাইনে নিজের মোবাইল বা কম্পিউটার দিয়ে আবেদন করে ইউ নিয়ন পরিষদে আবেদন করার চেয়ে তূলনামূলক দ্রুত সনদ হাতে পাওয়া
উত্তরাধিকার সনদ আবেদন
উত্তরাধিকারী সনদের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে Protayon.gov.bd ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। প্রথমে একটি নাগরিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে।
একাউন্ট তৈরির সময় জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন নম্বর, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা, ছবি ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ১০০% প্রোফাইল সম্পন্ন করতে হবে।
এরপর মোবাইল নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে “সেবা সমূহ” থেকে উত্তরাধিকারী সনদ সেবা নির্বাচন করুন। আবেদন ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অনলাইনে পেমেন্ট করে সাবমিট করুন
আবেদনটি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় চলে যাবে। পরে আবেদন নম্বর নিয়ে অফিসে গিয়ে আপনিসনদ সংগ্রহ করতে পারবেন।
উত্তরাধিকারী সনদের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
উত্তরাধিকারী সনদের আবেদন করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও তথ্যপত্র প্রস্তুত রাখতে হয়। নিচে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো তালিকাভুক্ত করা হলো:
১. মৃত ব্যক্তির তথ্য
- মৃত্যুর নিবন্ধন সনদ (Death Registration Certificate)
- মৃত্যুর তারিখ ও নিবন্ধন নম্বর
২. আবেদনকারীর তথ্য
আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
নাগরিক প্রোফাইল সম্পূর্ণ (Protayon.gov.bd-তে ১০০% প্রোফাইল কমপ্লিশন)
মোবাইল নম্বর ও ছবি সংযুক্ত প্রোফাইল
আরও পড়ুনঃ
৩. উত্তরাধিকারীদের তথ্য
সকল বৈধ উত্তরাধিকারীর নাম ও সম্পর্ক
প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর NID নম্বর অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ (যাদের NID নেই)
জন্মতারিখ
৪. ঠিকানা ও অন্যান্য
মৃত ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা
পরিবারের বর্তমান ঠিকানা
বিশেষ নির্দেশনা:
উত্তরাধিকারীর তালিকা থেকে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না।
জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।
সব তথ্য নির্ভুল ও হালনাগাদ থাকতে হবে, নতুবা আবেদন বাতিল হতে পারে।
অনলাইন উত্তরাধিকারী সনদের আবেদন করার নিয়ম
হাতে থাকা মোবাইল কিংবা কম্পিউটার ব্যবহার করে খুব সহজেই আপনি অনলাইনে উত্তরাধিকারী সনদের জন্য আবেদন করতে পারেন। নিচে ধাপে ধাপে আবেদন প্রক্রিয়া তুলে ধরা হলো:
ধাপ ১: নাগরিক একাউন্ট তৈরি করুন
প্রথমেই আপনাকে prottoyon.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি নাগরিক একাউন্ট খুলতে হবে
এই একাউন্ট খোলার সময় নিচের তথ্যগুলো সঠিকভাবে দিতে হবে:
- নাম
- পিতার নাম
- ঠিকানা
- ছবি
- জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম নিবন্ধন
একাউন্ট খোলার পর সেটি ১০০% সম্পূর্ণ করতে হবে
তবেই আপনি আবেদন করতে পারবেন।
রও পড়ুনঃ নাগরিক একাউন্ট খোলার নিয়ম ও ধাপসমূহ ২০২৫
ধাপ ২: প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে লগইন করুন

এই ধাপে আপনাকে prottoyon.gov.bd ওয়েবসাইটে লগইন করতে হবে।
লগইন করার জন্য:
যে মোবাইল নম্বর দিয়ে আপনি নাগরিক প্রোফাইল তৈরি করেছিলেন, সেটি ব্যবহার করুন।
প্রোফাইল তৈরি করার সময় যেই OTP (ওটিপি) আপনার মোবাইলে এসেছিল, সেটিই আপনার পাসওয়ার্ড হিসেবে কাজ করবে।
এই মোবাইল নম্বর এবং ওটিপি ব্যবহার করে সহজেই আপনি ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারবেন।
ধাপ ৩: ড্যাশবোর্ড থেকে উত্তরাধিকারী সনদ নির্বাচন করুন

প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে লগইন করার পর প্রথমে ড্যাশবোর্ড অপশনে ক্লিক করুন।
সেবা সমূহ থেকে উত্তরাধিকারী সনদ বেছে নিন।

সেখানে আবেদন করার আগে কী কী তথ্য প্রয়োজন, তার তালিকা দেখতে পাবেন (যেমন: আবেদনকারীর তথ্য, উত্তরাধিকারীর তথ্য, পরিচয়পত্র নম্বর ইত্যাদি)।
সব ঠিক থাকলে আবেদন লেখায় ক্লিক করুন।
ধাপ ৪: মৃত ব্যক্তির তথ্য যাচাই
আবেদন অপশনে ক্লিক করলে নতুন ফরম আসবে। সেখানে:

- মৃত ব্যক্তির মৃত্যু নিবন্ধন নম্বর (ডিজিটাল ইংরেজি সংখ্যায়) দিন,
- মৃত্যুর তারিখ লিখুন।
- তারপর যাচাই অপশনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৫: মৃত ব্যক্তির বিবরণ অটোমেটিকভাবে বসানো হবে

যাচাই অপশনে ক্লিক করার পর সিস্টেম থেকে মৃত ব্যক্তির নাম, পিতার নাম, মাতার নাম এবং অন্যান্য বিবরণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে (অটোমেটিকভাবে) ফরমে বসে যাবে। এরপর আপনাকে শুধু উত্তরাধিকারীদের তথ্য যুক্ত করতে হবে।
ধাপ ৬: মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের বিবরণ যুক্ত করা
এই ধাপে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে:

- জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা জন্ম নিবন্ধন নম্বর
- জন্মতারিখ
- সম্পর্ক নির্বাচন (স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা ইত্যাদি)
- মোবাইল নম্বর
সম্পর্ক অপশনে ক্লিক করলে বিভিন্ন সম্পর্কের তালিকা দেখতে পাবেন, সেখান থেকে সঠিকটি নির্বাচন করতে হবে।
যদি নতুন ওয়ারিশ যুক্ত করতে চান, তাহলে ‘আরও যোগ করুন’ অপশনে ক্লিক করুন।
লাল চিহ্নিত ঘরগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে, না হলে আবেদন সম্পূর্ণ হবে না।
সব তথ্য সঠিকভাবে পূরণ হলে, ‘জমা দিন’ (Submit) অপশনে ক্লিক করুন, এবং আপনার আবেদন সম্পূর্ণ করুন।
ধাপ ৭: তথ্য যাচাই এবং আবেদন সম্পূর্ণ করা
এই ধাপে মৃত ব্যক্তি এবং ওয়ারিশগণের সব তথ্য আপনার সামনে প্রদর্শিত হবে।


যদি সব তথ্য সঠিক থাকে, তাহলে ‘জমা দিন’ অপশনে ক্লিক করুন।
যদি কোনো তথ্য ভুল হয়ে থাকে, তাহলে ‘পরিবর্তন’ অপশনে ক্লিক করে সংশোধন করুন।
ধাপ ৮: তথ্য হালনাগাদ এবং চূড়ান্ত যাচাই

এই ধাপে আপনার সকল তথ্য প্রদর্শিত হবে, যেমন:
- নাম
- পিতার নাম
- মাতার নাম
- বর্তমান ঠিকানা
- স্থায়ী ঠিকানা
যদি সব তথ্য সঠিক থাকে, তাহলে ‘সব ঠিক আছে’ বোতামে ক্লিক করুন।
ধাপ ৯: অনলাইন পেমেন্ট সম্পন্ন করুন
এই ধাপে অনলাইনে উত্তরাধিকারী সনদের আবেদন সম্পন্ন করতে হবে।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় সনদ চাইলে: পেমেন্ট করতে হবে ৩০ টাকা।
শুধু বাংলায় সনদ চাইলে: পেমেন্ট করতে হবে ১৫ টাকা।
পেমেন্ট করতে পারবেন:
- ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
- মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি)
- ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড
এছাড়াও, এই ধাপে আপনাকে করতে হবে:
ঠিকানা ধরনের নির্বাচন: স্থানীয় বা বর্তমান ঠিকানা
অফিস নির্বাচন: যে অফিস থেকে সনদ তুলবেন, তা সিলেক্ট করতে হবে
পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর আবেদন প্রক্রিয়া শেষ হবে এবং সনদ সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হবে।
ধাপ ১০: আবেদন জমা ও ডকুমেন্ট সাবমিট
সব তথ্য ও পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পরে:
আবেদনটি জমা দিন এবং আবেদন আইডি সংরক্ষণ করুন।
এরপর আবেদন আইডি এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিকটস্থ ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন অফিসে জমা দিতে হবে।
অফিসে সবকিছু জমা দেওয়ার পর সহজেই আপনার উত্তরাধিকারী সনদ সংগ্রহ করতে পারবেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আমি নিজে অনলাইনে উত্তরাধিকারী সনদের জন্য আবেদন করেছিলাম। প্রথমে কিছুটা জটিল মনে হলেও ধাপে ধাপে নির্দেশনা মেনে চলায় পুরো প্রক্রিয়াটা সহজ হয়ে যায়। নাগরিক একাউন্ট তৈরি থেকে শুরু করে পেমেন্ট পর্যন্ত সব কিছু অনলাইনে সম্পন্ন হওয়ায় অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি, কেবল শেষ ধাপে ডকুমেন্ট জমা দিতে গিয়েছিলাম। তাই বলব, সবার উচিত এখন থেকে অনলাইনে আবেদন করা—এতে সময় ও খরচ দুই-ই বাঁচে।
শেষ কথা
উত্তরাধিকারী সনদ অনলাইনে করা এখন খুব সহজ, শুধু ধাপে ধাপে নির্দেশনা মেনে চললেই হবে। আশা করি এই আর্টিকেল থেকে আপনি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা বুঝতে পেরেছেন। যদি কোনো ধাপে সমস্যা হয় বা কোনো প্রশ্ন থাকে, নির্দ্বিধায় কমেন্ট বা বার্তা করে জানাতে পারেন। আপনার অভিজ্ঞতা বা মতামতও শেয়ার করতে ভুলবেন না!
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: অনলাইনে উত্তরাধিকারী সনদ পেতে কত টাকা লাগে?
উত্তর: কেবল বাংলায় আবেদন করলে ১৫ টাকা, আর বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষায় আবেদন করলে ৩০ টাকা লাগে।
প্রশ্ন ২: নাগরিক অ্যাকাউন্ট না খুললে কি অনলাইনে আবেদন করা যাবে?
উত্তর: না, প্রথমে prottoyon.gov.bd তে নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
প্রশ্ন ৩: পেমেন্ট করার সময় কী কী অপশন থাকে?
উত্তর: ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ), এবং ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায়।
প্রশ্ন ৪: আবেদন জমা দেওয়ার পরে কি করতে হবে?
উত্তর: আবেদন আইডি সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিকটস্থ অফিসে জমা দিতে হবে।
প্রশ্ন ৬: ভুল তথ্য দিলে কীভাবে ঠিক করবো?
উত্তর: তথ্য যাচাইয়ের ধাপে “পরিবর্তন করুন” অপশনে ক্লিক করে ঠিক করতে পারবেন।